ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল: Earthquakes.
ভূমিকম্প কী?
ভূ-অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণে সৃষ্ট কোনো আকস্মিক কম্পনের ফলে যখন ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ অল্প সময়ের জন্য মৃদু বা প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে, তখন তাকে ভূমিকম্প বলা হয়। সাধারণত ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৫ থেকে ৭০০ কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ লক্ষ বার ভূমিকম্প ঘটে। যদিও এর অধিকাংশই এত দুর্বল যে মানুষ তা অনুভব করতে পারে না। তবে কিছু শক্তিশালী ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংস ও প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভূমিকম্পের কারণ:
ভূমিকম্পের কারণকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়—
- প্রাকৃতিক কারণ।
- অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণ।
ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ:
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত:
আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সময় গ্যাস, জলীয় বাষ্প, লাভা ও উত্তপ্ত তরল পদার্থ প্রচণ্ড বেগে ভূপৃষ্ঠে নির্গত হয়। এই প্রবল শক্তির অভিঘাতে ভূ-অভ্যন্তরে কম্পনের সৃষ্টি হয় এবং ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ধস (Landslide):
প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে যখন পাহাড়ের বিশাল অংশ ভেঙে নেমে আসে, তখন ভূ-পৃষ্ঠে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হয়। এর ফলেও অনেক সময় ভূমিকম্প ঘটে।
পাতের সঞ্চরণ (Plate Movement):
বর্তমানে ভূমিকম্প সৃষ্টির সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো পাতসংস্থান তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী—
- দুটি পাত পরস্পরের দিকে এগিয়ে এলে
- অথবা পরস্পর থেকে দূরে সরে গেলে
- কিংবা পাশাপাশি ঘর্ষণ করতে করতে চললে
পাতের সংযোগস্থলে প্রচণ্ড চাপ জমা হয়। একসময় এই চাপ মুক্ত হয়ে শিলাচ্যুতি ঘটে এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
হিমানী সম্প্রপাত:
উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জমে থাকা বিশাল বরফস্তূপ যখন হঠাৎ ভেঙে নিচে নেমে আসে, তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি হয় এবং ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ভঙ্গিল পর্বতের উত্থান:
ভূ-আলোড়নের ফলে ভঙ্গিল পর্বত গঠনের সময় ভূ-অভ্যন্তরে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপ মুক্ত হওয়ার ফলে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটে।
উল্কাপাত:
মহাকাশ থেকে কোনো বৃহৎ উল্কা পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে তার প্রচণ্ড অভিঘাতে ভূমিকম্প হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ— আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যে উল্কাপাতের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিশাল গহ্বরটি ‘শয়তানের খাদ’ নামে পরিচিত।
ভূমিকম্পের অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণ:
মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলেও ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। যেমন—
- বৃহৎ জলাধারে জল জমে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলে
- ভূগর্ভে পারমাণবিক বিস্ফোরণ বা ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটালে
- অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলে খনির ছাদ ধসে পড়লে
এই ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে কৃত্রিম ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
ভূমিকম্পের ফলাফল বা প্রভাব:
ভূমিকম্প মানবসভ্যতার জন্য একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর প্রভাব বহু দিক থেকে লক্ষ্য করা যায়।
জীবন ও সম্পত্তিহানি:
ভূমিকম্পের ফলে ঘরবাড়ি, বহুতল ভবন, সেতু ইত্যাদি ভেঙে পড়ে। এতে অসংখ্য মানুষ ও গৃহপালিত পশুর মৃত্যু ঘটে এবং বিপুল পরিমাণ সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নষ্ট হয়।
পরিবহণ ব্যবস্থার বিপর্যয়:
ভূমিকম্পের ফলে—
- রাস্তাঘাট ফেটে যায়
- রেললাইন বেঁকে যায় বা বসে যায়
- পাহাড়ি এলাকায় ধস নামে
ফলে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাঁধ ভেঙে হঠাৎ বন্যা:
ভূমিকম্পের ফলে বড় জলাধার বা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিপুল জলরাশি একসঙ্গে বেরিয়ে এসে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে।
উদাহরণস্বরূপ— ১৯৬৭ সালে মহারাষ্ট্রের কয়না বাঁধে ভূমিকম্পের ফলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল।
সুনামির সৃষ্টি:
সমুদ্রের তলদেশে ভূমিকম্প হলে বিশাল জলরাশি স্থানচ্যুত হয় এবং সুনামির সৃষ্টি হয়। এই সুনামি উপকূল অঞ্চলে আছড়ে পড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
উদাহরণস্বরূপ— ২০০৪ সালে সুমাত্রার নিকট ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ভূমিকম্পে সুনামির ফলে ১১টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।
নতুন ভূভাগের সৃষ্টি:
অনেক সময় ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের তলদেশের কোনো অংশ ভেসে উঠে নতুন ভূভাগ তৈরি হয়।
যেমন— ২০১৩ সালে করাচির উপকূলে একটি কাদার দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছিল।
বন্দর গঠনে সহায়তা:
ভূমিকম্পের ফলে উপকূলবর্তী কোনো অঞ্চল নিমজ্জিত হলে সেখানে প্রাকৃতিক বন্দর গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে বাণিজ্যের পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
উপসংহার:
ভূমিকম্প একটি অনিবার্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি, ভূমিকম্প সহনশীল নির্মাণ, সচেতনতা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাই ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন ও প্রস্তুতিই পারে মানবজীবন ও সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ।




Post Comment