মৌসুমী বায়ু কাকে বলে? ভারতের মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব:

মৌসুমী বায়ু কাকে বলে? ভারতের মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব:

মৌসুমী বায়ু কাকে বলে?

আরবী ‘মওসুম’শব্দ হতে মৌসুমী শব্দের উৎপত্তি। মওসুম শব্দের অর্থ ঋতু।এ বায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এর দিক পরিবর্তন হয়। আবার কারো কারো মতে এ মালয়ী শব্দ ‘মনসিন’হতে উদ্ভব হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার যে বায়ুপ্রবাহ ছয়মাস উত্তর-পূর্ব দিক হতে এবং ছয়মাস দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয় তাকে মৌসুমী বায়ু বলে। আবার শীত ও গ্রীষ্মকালের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহকে মৌসুমী বায়ু বলে।

মৌসুমী বায়ু দুই প্রকার যেমন:

  • গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ু
  • শীতকালীন মৌসুমী বায়ু

গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ু বলতে কী বোঝ?

গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। এতে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থলভাগ উত্তপ্ত হয় এবং সেখানকার বায়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এজন্য ঐ সময় নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলভাগ সেই সময় অপেক্ষাকৃত কম গরম থাকায় সেখানে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়।এই উচ্চচাপযুক্ত জলভাগ এলাকা থেকে বায়ু এশিয়ার স্থলভাগে সৃষ্ট নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

ফেরেলের সূত্রানুসারে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এ বায়ু বছরের এক নির্দিষ্ট সময়ে বা ঋতুতে প্রবাহিত হয় বলে একে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বলা হয়। এই বায়ু দীর্ঘপথ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে বলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ থাকে এবং হিমালয় ও অন্যান্য উচ্চ পর্বতগাত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।

এর প্রভাবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে এবং কৃষির উন্নতি হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু দুটি শাখায় বিভক্ত, (ক) আরবসাগরীয় শাখা এবং (খ) বঙ্গোপসাগরীয় শাখা। আরবসাগরীয় শাখা আরব সাগর থেকে এবং বঙ্গোপসাগরীয় শাখা বঙ্গোপসাগর থেকে উৎপত্তি হয়।

শীতকালীন মৌসুমী বায়ু বলতে কী বোঝ?

সূর্যের দক্ষিণায়নের সাথে সাথে উত্তর গোলার্ধে উত্তাপ কমতে থাকে ও উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়।এ সময় সূর্য দক্ষিণে মকরক্রান্তি রেখার নিকট অগ্রসর হয়ে লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে মকরক্রান্তির নিকটবর্তী দেশগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।এই সময় মধ্য এশিয়ার উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চল থেকে শীতল, ভারী ও শুষ্ক বায়ু সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। একে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু বলা হয়।

এ বায়ুর একটি অংশ জাপান সাগর ও বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করার পর যথাক্রমে জাপান ও তামিলনাডুতে বৃষ্টিপাত ঘটায়। উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ গোলার্ধে এসে পৌঁছলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু নামে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করে। সেখানে এ বায়ু গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী রূপে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।

মৌসুমী বিস্ফোরণ কাকে বলে?

কোন কোন বছর দেখা যায় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারত তথা অন্যান্য মৌসুমী বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চল গুলিতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় যা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি। ফলস্বরূপ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একেই বলা হয় মৌসুমী বিস্ফোরণ। সাধারণত যে যে বছর প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না সে সে বছর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।

মৌসুমী বায়ুর ছেদ বা বিরাম বলতে কী বোঝ?

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আরব সাগরীয় শাখা হতে ভারতে প্রবেশ করে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু এই বৃষ্টি সব সময় একই রকম হয় না বলে কখনো কখনো ৭ থেকে ১৫ দিন বিরাম নেওয়ার পর আবার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। একেই মৌসুমী বায়ুর ছেদ বা বিরাম বলা হয়।

ভারত কে কেন মৌসুমি বায়ুর দেশ বলা হয়?

মৌসিম’ শব্দে এর অর্থ হল ঋতু। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমি বায়ু প্রবাহেরও পরিবর্তন হয়। স্থলভাগ ও জলভাগের উত্তাপের পার্থক্যের ফলে সমুদ্র বায়ু এবং স্থল বায়ুর মতো মৌসুমি বায়ুরও সৃষ্টি হয়। ভারতের জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতে মৌসুমি বায়ুর বিরাট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এইজন্য ভারতকে মৌসুমি বায়ুর দেশ বলা হয়।

ভারতের মৌসুমি জলবায়ুর চারটি প্রধান ঋতু:

শীতকাল (ডিসেম্বর – ফেব্রুয়ারি):

  • শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়া।
  • উত্তর ভারতে রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়।
  • পশ্চিমা ঝড় বয়ে নিয়ে আসে কিছু বৃষ্টিপাত, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে।

গ্রীষ্মকাল (মার্চ – মে):

  • অত্যন্ত গরম ও শুষ্ক সময়।
  • অনেক স্থানে তাপমাত্রা ৪০°C-এর ওপরে পৌঁছে যায়।
  • খরার প্রবণতা দেখা যায়।

বর্ষাকাল (জুন – সেপ্টেম্বর):

  • দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে এবং ভারি বৃষ্টিপাত ঘটায়।
  • কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।
  • পশ্চিমঘাট ও আসাম অঞ্চলে সর্বাধিক বৃষ্টি হয়।

পশ্চাৎ বর্ষা বা শরৎকাল (অক্টোবর – নভেম্বর):

  • মৌসুমি বায়ু ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণ করে।
  • দক্ষিণ ভারতে কিছু বৃষ্টি হয় পূর্ব-উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর কারণে।
  • আবহাওয়া ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে।

ভারতের মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য:

  • মৌসুমি বায়ুর ওপর নির্ভরকরে বৃষ্টিপাত হয়।
  • ঋতুভেদে তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়।
  • বৃষ্টিপাতের অসাম্য – কিছু অঞ্চলে অতিবৃষ্টি, কিছু অঞ্চলে অনাবৃষ্টি হয়।
  • কৃষি, জলসম্পদ ও অর্থনীতির উপর মৌসুমি জলবায়ুর গভীর প্রভাব পড়ে।

ভারতের মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব:

  • ভারত ‘আন্তঃমৌসুমি জলবায়ুর দেশ‘ হওয়ায় ভারতের অধিকাংশ বৃষ্টিপাত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঘটে থাকে। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, শরৎকালে প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালে উত্তর–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ভারতের জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের উপর সবচেয়ে বেশি থাকে। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পূর্ব এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব এই দুটি বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহের ফলে ভারতে আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল এই দুটি প্রধান ঋতুর সৃষ্টি হয়েছে।
  • দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে আগত মৌসুমি বায়ুতে প্রচুর জলীয় বাস্প থাকে বলে বর্ষাকালের জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে।
  • বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে পশ্চিম উপকূলের উত্তরাংশ, অসম, মিজোরাম, পূর্ব হিমালয়, তরাই অঞ্চল এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।
  • দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখার প্রভাবে উত্তর–পূর্ব ভারতের গারো, খাসি ও পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশবর্তী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও এই সব অঞ্চলের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাত ক্রমশ কমে যেতে থাকে।
  • দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখার প্রভাবে দক্ষিণ থেকে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে।
  • মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে খাসি, গারো, পূর্ব হিমালয় এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের প্রতিবাত ঢালে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত হলেও অনুবাত ঢালে বৃষ্টিহীন বা অল্পবৃষ্টিযুক্ত বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে।
  • অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে শরৎকাল অথবা শীতকালের শুরুতে প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় এবং করমণ্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত ঘটে।
  • উত্তর–পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শীতকালে ভারতে বৃষ্টিপাত খুব একটা হয় না, কেবল মাত্র করমণ্ডল উপকূলে ডিসেম্বর মাসে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়।
  • দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা কিছুটা কমে যায়।
  • মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে হিমালয় পর্বত সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে চিরহরিৎ, পর্ণমোচী এবং সরলবর্গীয় বৃক্ষের গভীর অরণ্যে সৃষ্টি হয়েছে। এইসব অরণ্য থেকে মুল্যবান কাঠ এবং অন্যান্য অরণ্য সম্পদ পাওয়া যায়।

Post Comment

close