হিমবাহ (Glacier): সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও ভূমিরূপ: (Glaciers: Definition, Types and Landforms).

হিমবাহ (Glacier): সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও ভূমিরূপ: (Glaciers: Definition, Types and Landforms).

Table of Contents

ভূমিকা:

পৃথিবীর শীতল ও পার্বত্য অঞ্চলে এমন কিছু বিশাল বরফস্তূপ আছে, যেগুলি ধীরে ধীরে নীচের দিকে গড়িয়ে যায়। এই বরফস্তূপকে বলা হয় হিমবাহ (Glacier)
হিমবাহ পৃথিবীর জলবায়ু, নদী-ব্যবস্থা এবং ভূমিরূপ গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১. হিমবাহ (Glacier) কাকে বলে?

উঃ- বিশালাকার বরফের স্তূপ অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হয়ে সরে গেলে তাকে হিমবাহ বলে। এগুলি মূলত পার্বত্য তুষারাঞ্চলে দেখা যায়।

২. হিমবাহ কিভাবে গঠিত হয়?

উঃ- পাহাড়ের চূড়ায় প্রচণ্ড শীতল অবস্থায় প্রচুর তুষারপাত হয়। সেই তুষার স্তরে স্তরে জমে চাপের ফলে বরফে পরিণত হয়। এই বরফ অভিকর্ষের টানে নীচের দিকে সরে এসে হিমবাহ সৃষ্টি করে।

৩. হিমরেখা (Iceline) কাকে বলে?

উঃ- ভূপৃষ্ঠের সেই সীমারেখা যেখানে সারাবছর তুষার জমে থাকে এবং তার নীচে তুষার গলে যায়, তাকে হিমরেখা বলে। উচ্চতা অনুযায়ী এই রেখার অবস্থান পরিবর্তিত হয়।

৪. হিমশৈল (Iceberg) কাকে বলে?

উঃ- সমুদ্রজলে ভাসমান বিশাল বরফখণ্ডকে হিমশৈল বলে। এরা মূলত স্থলভাগীয় হিমবাহ থেকে ভেঙে সমুদ্রে পড়ে। হিমশৈলের প্রায় ১/১২ অংশই জলের উপরে দৃশ্যমান থাকে।

৫. হিমবাহের প্রকারভেদ কী কী?

উঃ- অবস্থান ও প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে হিমবাহ দুই প্রধান প্রকারের:

  • (ক) উপত্যকীয় হিমবাহ (Valley Glacier)
  • (খ) মহাদেশীয় হিমবাহ (Continental Glacier)

৬. উপত্যকীয় হিমবাহ কাকে বলে?

উঃ- পর্বত উপত্যকার মধ্যে দিয়ে নেমে আসা দীর্ঘ বরফধারাকে উপত্যকীয় হিমবাহ বলে। যেমন— আল্পস, হিমালয়, রকি প্রভৃতি পর্বতে পাওয়া যায়।

৭. মহাদেশীয় হিমবাহ কাকে বলে?

উঃ- পুরো মহাদেশের বৃহৎ অংশ জুড়ে থাকা বিশাল বরফস্তূপকে মহাদেশীয় হিমবাহ বলে। যেমন— অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ড।

৮. বার্গমুন্ড কাকে বলে?

উঃ- পর্বতের পার্শ্ব দিয়ে হিমবাহ নামার সময় সৃষ্ট সংকীর্ণ বরফপূর্ণ ফাঁক বা উপত্যকাকে বার্গমুন্ড বলা হয়।

৯. করি বা সার্ক কাকে বলে?

উঃ- পাহাড়ি অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয় ও অবক্ষয়ের ফলে অর্ধবৃত্তাকার বা থালা আকৃতির খাত সৃষ্টি হয়, তাকে করি (Corrie) বা সার্ক (Cirque) বলা হয়।

১০. হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান (Glacial Stairway) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে উপত্যকার তলদেশে ধাপে ধাপে সিঁড়ি আকৃতির ভূমিরূপ গঠিত হলে তাকে হিমসিঁড়ি বা হিমসোপান বলে।

১১. ঝুলন্ত উপত্যকা (Hanging Valley) কাকে বলে?

উঃ- ছোট হিমবাহ বড় হিমবাহের সাথে মিলিত হলে ছোট উপত্যকাটি প্রধান উপত্যকার অনেক উপরে অবস্থান করে, একে ঝুলন্ত উপত্যকা বলে।

১২. ক্র্যাগ ও টেল (Crag and Tail) কাকে বলে?

উঃ- প্রবাহমান হিমবাহের পথে কঠিন শিলা বাধা সৃষ্টি করলে তার সামনে উঁচু অংশ গঠিত হয় (ক্র্যাগ) এবং পিছনে সঞ্চয়ী উপাদান দিয়ে গঠিত হয় লেজের মতো অংশ (টেল)।

১৩. আবর্তরেখা (Grooving) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের ঘর্ষণকার্যে শিলাস্তরে দীর্ঘ, গভীর খাঁজ বা রেখা সৃষ্টি হয়, যাকে আবর্তরেখা বলে।

১৪. গ্রাবরেখা বা মোরেন (Moraine) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহ বরফের সাথে নিয়ে আসা পাথর, নুড়ি, বালি ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে সঞ্চিত হলে যে রেখা সৃষ্টি হয় তাকে মোরেন বলে। এটি চার প্রকার—

  • পার্শ্বীয় মোরেন (Lateral Moraine)
  • মধ্য মোরেন (Medial Moraine)
  • অন্তঃস্থ মোরেন (Ground Moraine)
  • অগ্র মোরেন (Terminal Moraine)

১৫. ড্রামলিন (Drumlin) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের দ্বারা সঞ্চিত মিশ্র পদার্থ উল্টো নৌকার মতো আকৃতির ঢিবি তৈরি করলে তাকে ড্রামলিন বলে।

১৬. হিমবাহ হ্রদ (Tarn) কাকে বলে?

উঃ- সার্ক বা করি অঞ্চলে গলে যাওয়া বরফে তৈরি ছোট গোলাকার হ্রদকে হিমবাহ হ্রদ বলে।

১৭. বোল্ডার ক্লে বা টিল বহিধৌত সমভূমি (Outwash Plain) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের প্রান্তে গলে যাওয়া বরফের সাথে মিশে আসা পলি, নুড়ি ও বালি জমে গঠিত সমভূমিকে বহিধৌত সমভূমি বলে।

১৮. এস্কার (Esker) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের নিচে প্রবাহিত বরফগলিত জলের স্রোতের তলদেশে বালু ও নুড়ির সঞ্চয়ে সাপের মতো টিলা গঠিত হয়, একে এস্কার বলে।

১৯. কেম (Kame) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের পাশে বা ফাটলে সঞ্চিত পলি ও নুড়ি দ্বারা গঠিত ছোট ঢিবি বা টিলাকে কেম বলে।

২০. হিমবাহ উপত্যকা (U-Shaped Valley) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার ফলে ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে তৈরি প্রশস্ত ও সমতলতল উপত্যকা U-আকৃতির হয়। একে হিমবাহ উপত্যকা বলে।

২১. ফিয়র্ড (Fjord) কাকে বলে?

উঃ- উপকূলবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ ক্ষয় করে গভীর উপত্যকা তৈরি করলে এবং পরে সেটি সমুদ্রজলে প্লাবিত হলে তাকে ফিয়র্ড বলা হয়। উদাহরণ— নরওয়ে।

২২. রোচ মাউতোনে (Roches Moutonnées) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের ঘর্ষণকার্যে শিলার একদিক মসৃণ ও অন্যদিক খাড়া হলে এমন শিলা-আকৃতিকে রোচ মাউতোনে বলে।

২৩. গ্লেশিয়াল টিল (Glacial Till) কাকে বলে?

উঃ- হিমবাহের দ্বারা সঞ্চিত অবিন্যস্ত শিলাখণ্ড, বালি ও কাঁদার মিশ্রণকে গ্লেশিয়াল টিল বলে।

২৪. হিমবাহের ক্ষয়কার্য কীভাবে ঘটে?

উঃ- হিমবাহ চলমান অবস্থায় ঘর্ষণ (abrasion), খসান (plucking) ও অপঘর্ষণ প্রক্রিয়ায় শিলাকে ক্ষয় করে নতুন ভূমিরূপ সৃষ্টি করে।

২৫. হিমবাহের সঞ্চয়কার্য কীভাবে ঘটে?

উঃ- বরফ গলে যাওয়ার সময় হিমবাহের বহন করা শিলাখণ্ড, বালি, কাদা ইত্যাদি একত্রে জমা হয়। এর ফলে মোরেন, ড্রামলিন, এস্কার, কেম ইত্যাদি ভূমিরূপ গঠিত হয়।

২৬. হিমবাহের ভূমিরূপগুলির গুরুত্ব কী?

উঃ-

  • কৃষিক্ষেত্রে উর্বর ভূমি প্রদান করে।
  • প্রাকৃতিক হ্রদ ও নদীর সৃষ্টি করে।
  • পর্যটন কেন্দ্র গঠনে সাহায্য করে (যেমন আল্পস, হিমালয়)।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের সূচক হিসেবে কাজ করে।

হিমবাহ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ শব্দাবলি ও ধারণা:

ক্রমিক.পরিভাষাসংজ্ঞা / ব্যাখ্যা
১.হিমরেখা (Iceline)যে উচ্চতার উপরে সারাবছর বরফ জমে থাকে।
২.হিমশৈল (Iceberg)সমুদ্রজলে ভাসমান বিশাল বরফখণ্ড।
৩.বার্গমুন্ডপর্বতের গাত্রে হিমবাহ নেমে আসার ফলে সৃষ্ট ফাঁক।
৪.করি বা সার্ক (Cirque)হিমবাহ ক্ষয়ের ফলে থালা আকৃতির গহ্বর।
৫.হিমসিঁড়ি (Glacial Stairway)উপত্যকার তলদেশে ধাপে ধাপে গঠিত ভূমিরূপ।
৬.ঝুলন্ত উপত্যকা (Hanging Valley)ছোট হিমবাহ উপত্যকা বড় হিমবাহ উপত্যকার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।
৭.ক্র্যাগ ও টেল (Crag & Tail)হিমবাহের পথে কঠিন শিলার সামনে উঁচু অংশ (ক্র্যাগ) ও পেছনের টিলা (টেল)।
৮.গ্রাবরেখা বা মোরেন (Moraine)হিমবাহের সাথে সঞ্চিত নুড়ি, কাঁকর, কাদা ইত্যাদির রেখা।
৯.ড্রামলিন (Drumlin)উল্টানো নৌকার মতো ঢিবি আকৃতির সঞ্চয়ী ভূমিরূপ।
১০.এস্কার (Esker)হিমবাহের নিচে গলিত জলের স্রোতে সঞ্চিত সর্পিল টিলা।
১১.কেম (Kame)হিমবাহের পাশে জমে থাকা পলি ও নুড়ির টিলা।
১২.হিমবাহ উপত্যকা (U-shaped Valley)হিমবাহ ক্ষয়ের ফলে গঠিত প্রশস্ত ‘U’ আকৃতির উপত্যকা।
১৩.ফিয়র্ড (Fjord)হিমবাহ উপত্যকা সমুদ্রজলে প্লাবিত হলে যে খাড়ি গঠিত হয়।
১৪.হিমবাহ হ্রদ (Tarn)সার্ক অঞ্চলে গলে যাওয়া বরফে গঠিত ছোট হ্রদ।

উপসংহার:

হিমবাহ প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এটি একদিকে যেমন পৃথিবীর ভূমিরূপ পরিবর্তন করে, অন্যদিকে জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। তাই ভূগোলে হিমবাহের অধ্যয়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Sukanta Das is the founder of Studyniea.in. He holds a Master’s degree (M.A) in Political Science and has a strong passion for education, especially in the fields of general studies and current affairs. With years of academic experience and a clear understanding of students' needs, he created Studyniea.in to offer reliable, easy-to-understand, and exam-focused content for learners preparing for school exams and competitive government exams. His mission is to build a supportive learning platform where students can grow their knowledge and confidence, step by step.

Post Comment

error: Content is protected !!