নদীর কাজ ও নদীর বিভিন্ন ভূমিরূপ:
নদী কাকে বলে?
উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল বা মালভূমি থেকে বৃষ্টির জল,হিমবাহ গলা জল অথবা হ্রদ বা ঝর্ণার জল যখন ভূমির ঢাল অনুসরণ করে বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়ে স্বাভাবিক জলধারা সৃষ্টি করে ও কোনো সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা অন্য কোনো জলাশয়ে গিয়ে পতিত হয়, তখন তাকে নদী বলে।
উদাহরণ:- গঙ্গা, সিন্ধু প্রভৃতি।
নদীর কাজ:
উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ গতিপথে নদী প্রধানত তিন ভাবে কাজ করে থাকে, যথা-
- ক্ষয়সাধন।
- বহন।
- অবক্ষেপণ।
ক্ষয়সাধন: ভূমি ক্ষয় করা নদীপ্রবাহের প্রধান কাজ। নদীর এই কাজকে ক্ষয়সাধন বলা হয়েছে। পার্বত্য গতিপথে ভূমি বেশি ঢালু হওয়ার জন্য সেখানে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয়সাধন।
বহন: ক্ষয়কার্যের ফলে যে সব শিলাচূর্ণ,বালি, কাঁকর, কাদা, নুড়ি, পলিমাটি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়,সেগুলিকে বহন করার কাজকে নদীর বহন বা পরিবহন বলে।
নদীর পার্বত্যপ্রবাহে ও মধ্য গতিপথে শিলাচূর্ণ, বালি, কাঁকর, কাদা, নুড়ি, পলিমাটি প্রভৃতি বহন করা নদীর একটি প্রধান কাজ ।
অবক্ষেপণ: অবক্ষেপন মানে জমা করা। নদী বাহিত শিলাচূর্ণ, বালি, কাঁকর, কাদা, নুড়ি, পলিমাটি প্রভৃতি নদীর দুই কূলে ও মোহনায় জমা করার কাজকে অবক্ষেপন বলে। নদীর বহন ক্ষমতা যখন কমে যায়, তখন নদীর অবক্ষেপনের কাজ শুরু হয়।
কাজ অনুসারে নদীপ্রবাহের বিভাগ:
কাজ অনুসারে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত একটি আদর্শ নদীর গতিপথকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- পার্বত্যগতি।
- মধ্যগতি।
- নিম্নগতি।
পার্বত্যগতি: পার্বত্য গতিতে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয় সাধন, এবং ক্ষয় সাধনের সঙ্গে সঙ্গে নদী বহনের কাজ ও করে থাকে।
মধ্যগতি: মধ্যগতিতে নদীর প্রধান কাজ বহন। এই পর্যায়ে নদী অবক্ষেপন ও করে, আবার কূল ভাঙ্গে ও গড়ে।
নিম্নগতি: নিম্নগতিতে নদীর প্রধান কাজ অবক্ষেপণ। এখানে নদী প্রধানত নদী বাহিত শিলাচূর্ণ, বালি, কাঁকর, কাদা, নুড়ি, পলিমাটি প্রভৃতি জমা করে এবং সমভূমি ও ব-দ্বীপ ভূমি গড়ে তোলে।
আদর্শ নদী কাকে বলে?
উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গতিপ্রবাহে তিনটি অবস্থা, যথা:- উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন গতিপ্রবাহ ও বিভিন্ন গতিপ্রবাহে নদীর কাজ সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়, তাকে প্রাকৃতিক দিক থেকে ‘আদর্শ নদী’ বলা হয় । গঙ্গা নদীকে আদর্শ নদী বলা হয়।
শাখা নদী কাকে বলে?
নদীর মূল জলপ্রবাহ থেকে যেসব জলধারা শাখার আকারে বেরিয়ে অন্যত্র পতিত হয়, তাকে শাখানদী বলে।
উদাহরণ:- গঙ্গার প্রধান শাখা হল পদ্মা।
উপনদী কাকে বলে?
প্রধান নদির গতিপথে অনেকস্থানে ছোট ছোটো নদী এসে মূল নদীতে মিলিত হয়, এইসব ছোটো নদীকে প্রধান নদীর উপনদী বলা হয়।
উদাহরণ:- যমুনা গঙ্গার একটি উপনদী।
নদী অববাহিকা কাকে বলে?
যে অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রধান নদী এবং তার শাখানদী ও উপনদী প্রবাহিত হয় সেই অঞ্চলকে মূল নদীর অববাহিকা বলা হয়।
উদাহরণ:- উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি হল গঙ্গার অববাহিকা।
নদী উপত্যকা কাকে বলে?
নদীর উৎপত্তি স্থল থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত যে খাতের মধ্যদিয়ে নদীর জলধারা প্রবাহিত হয়, সেই খাতকে নদী উপত্যকা বলে।
নদীর ক্ষয়কার্য ও বহনকার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ:
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর প্রাথমিক গতি। এখানে নদীর স্রোত খুব প্রবল ও গভীরতা খুব বেশি। নদী এখানে খুব বেশি চওড়া হয় না। পর্বতের গা দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে নদী এখানে বইতে থাকে এবং নানা রকমের ভূমিরূপ গঠন করে থাকে।
আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ:
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ। পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ বা নদীর প্রবাহ পথে, নদীর ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত ও খাঁজ-কাটা শৈলশিরাগুলিকে অভিক্ষিপ্তাংশ বলে। পার্বত্য অঞ্চলে কোনও নদীর গতিপথে অনেক সময় পাহাড়গুলির অভিক্ষিপ্তাংশ এমন ভাবে বিন্যস্ত থাকে যে, নদীর প্রবাহপথের একটি অংশ আর একটি অংশ থেকে আড়াল হয়ে যায় এবং নদীটি সামান্য একটু বাঁক নিয়ে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় দূর থেকে দেখলে নদীটির গতিপথ আড়াল হয়ে এবং মনে হয় শৈলশিরাগুলি যেন আবদ্ধ অবস্থায় আছে, একে তখন আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ বলে।
কর্তিত স্পার:
পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে যখন হিমবাহ অগ্রসর হয়, সে সময় এই হিমবাহের গতিপথে যেসব স্পার বা পর্বতের অভিক্ষিপ্তাংশ হিমবাহের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে, হিমবাহ সেগুলিকে কেটে বা ক্ষয় করে সোজা পথে অগ্রসর হয় এবং খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে । এর ফলে পর্বতশিরার অবতল ও উত্তল ঢালটি হঠাৎ খাড়াভাবে হিমবাহ উপত্যকায় নেমে আসে। এইভাবে হিমবাহ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ত্রিভূজের মতো দেখতে শৈলশিরাগুলোকে কর্তিত স্পার বা পল কাটা স্পার বলে। যে কোনো নদীর পার্বত্য গতিপথে এই ধরনের বাধা থাকলে নদীটি এঁকে বাঁক প্রবাহিত হয়, যার ফলে আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশের সৃষ্টি হয়। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর গতিপথে কর্তিত শৈলশিরা দেখা যায়।
V – আকৃতি উপত্যকা ও গিরিখাত:
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, V -অক্ষরের উপত্যকা ও গিরিখাত হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । পার্বত্য অঞ্চলে স্রোতের বেগ প্রচন্ড হওয়ায় নদী বড় বড় শিলাখন্ড, নুড়ি, পাথর প্রভৃতি বহন করে নামতে থাকে । শিলাখন্ডের আঘাতে নদীগর্ভ ক্ষয় হয়। পার্বত্যপথে নদীর ইংরেজি I অথবা সরু V আকৃতির নদী-উপত্যকা যখন খুব গভীর হয়, তখন তাকে গিরিখাত বলে। গিরিখাত যতটা গভীর ততটা চওড়া নয়। কখনো কখনো এই সমস্ত গিরিখাতের তলদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী পর্বতের চূড়ার মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য প্রায় কয়েক হাজার মিটার হয়।
উদাহরণ- শতদ্রু, সিন্ধু, তিস্তা প্রভৃতি নদীর হিমালয়ের পার্বত্য গতিপথে গভীর নদী উপত্যকা বা গিরিখাত দেখতে পাওয়া যায়। সিন্ধুনদের অরুণ গিরিখাত বিখ্যাত। দক্ষিণ পেরুর কল্কা নদীর গিরিখাতটি হল বিশ্বের গভীরতম গিরিখাত যার গভীরতা সর্বাধিক ৪,৩৭৫ মিটার।
জলপ্রপাত ও প্রপাত কূপ:
পার্বত্য প্রবাহে নদীর গতিপথে আড়াআড়ি ভাবে কোনো কঠিন শিলা থাকলে, সেই কঠিন শিলা পাশের কোমল শিলা থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয় পায় এবং কালক্রমে উঁচু হয়ে থাকে। নদীস্রোত সেই খাড়া ঢাল থেকে বিপুল বেগে নীচের কোমল শিলায় পড়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে। নদীর গতিপথের যে অংশে জলপ্রপাতের জলধারা সজোরে এসে পড়ে সেখানে এই জলধারা সজোরে এসে পড়ার ফলে মন্থকূপের সৃষ্টি হয় যাকে প্রপাতকূপ বলে। জলপ্রপাতের উপস্থিতির ফলে নীচের কোমল শিলাস্তরের ভিতরের অংশের দ্রুত ক্ষয় হওয়ায় এই ধরনের জলপ্রপাত ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে আসতে থাকে, একে জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণ বলে। দক্ষিণ-আমেরিকার ভেনিজুয়ালার অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাতটি হল পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত।
ক্যানিয়ন:
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ক্যানিয়ন হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ। বৃষ্টিহীন মরুপ্রায় শুষ্ক অঞ্চলে ইংরেজী ‘I’ অক্ষরের মতো গিরিখাতকে ক্যানিয়ন বলা হয়। দীর্ঘপথ ধরে বৃষ্টিহীন পার্বত্য মরূ অঞ্চল দিয়ে কোনো নদী প্রবাহিত হলে নদীর জলের স্বল্পতার জন্য নদীখাতে শুধু মাত্র নিম্নক্ষয় হয়। শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম, ফলে দুই পাড় ভেঙ্গে জল নদীতে নেমে আসে না। তাই নদীর পার্শ্বক্ষয় বিশেষ হয় না। শুধুমাত্র নিম্নক্ষয়ের জন্য ‘I’ আকৃতির সুগভীর খাত বা ক্যানিয়নের সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় কলোরাডো নদী পৃথিবী বিখ্যাত গ্রান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে যার দৈর্ঘ হল ৪৪৬ কিলোমিটার এবং কোথাও কোথাও এর গভীরতা ১.৬ কিলোমিটারেরও বেশি।
নদীর বহন ও অবক্ষেপণের ফলে সৃষ্ট ভুমিরূপ:
নদীর বাঁক:
নদীর মধ্যগতিতে সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, নদীর বাঁক হল তাদের মধ্যে অন্যতম। মধ্যগতিতে এবং বিশেষ করে নিম্নগতিতে নদীর স্রোতের বেগ কমে যাওয়ায় নদী কোনো রকম বাধা অতিক্রম করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। নদী তার গতিপথে বাধা পেলে সেই বাধা এড়িয়ে আঁকা বাঁকা পথে নদী প্রবাহিত হতে থাকে। এই সময় নদীপ্রবাহের বাঁকা অংশকে নদীর বাঁক বলা হয়। বারাণসীর কাছে গঙ্গানদীর সুন্দর নদীর বাঁক দেখা যায়।
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ:
নদীর মধ্যগতিতে নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ হল তাদের মধ্যে অন্যতম। বাঁক ঘোরার সময় নদী তীরের যে জায়গা ঠিক স্রোতের মুখে পড়ে, সেই জায়গায় স্রোতের আঘাত সবচেয়ে বেশি লাগে। ফলে ওই জায়গায় নদী তীর ভাঙ্গতে থাকে এবং অপর দিকে নদী তীরে স্রোতের আঘাত বিশেষ না লাগায় নদী বাহিত বালি, পলি, কাদা, কাঁকর, শিলাচূর্ণ, নুড়ি প্রভৃতি জমে চড়ার সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলার ফলে নদীর বাঁক বাড়তে থাকে ও দুই বাঁকের মধ্যবর্তী স্থান ক্রমাগত ক্ষয় পেতে থাকে ও সংকীর্ণ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দুই বাঁক পরস্পরের সঙ্গে মিলে যায় এবং নদীর পুরনো খাতের মুখ বন্ধ হয়ে বাওড় বা হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই রকম হ্রদ ঘোড়ার খুরের মত দেখতে হয়, তখন তাকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলা হয়। নদীর দুই বাঁকের মধ্যবর্তী পরস্পরের সঙ্গে মিলে জুড়ে গেলে নদী আবার সোজা পথে অগ্রসর হয়।
নদীর অবক্ষেপণের ফলে সৃষ্ট ভুমিরূপ:
নদী মধ্যপ্রবাহ থেকে মোহনার দিকে যতই অগ্রসর হতে থাকে, ততই নদীর স্রোতের বেগ কমতে থাকে। স্রোতের বেগ কমে যাওয়ায় শিলাচূর্ণ, নুড়ি, কাদা, পলি, বালি, প্রভৃতি নদী গর্ভে ও নদীর দুই তীরে জমা হতে থাকে। ফলে নানা রকম ভূমিরূপ গড়ে ওঠে।
প্লাবন ভূমি:
নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, প্লাবন ভূমি হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ।
- নদীর মধ্য ও নিম্ন গতিতে সমভূমি অঞ্চলে নদীর ঢাল ক্রমশ কমতে থাকায় নদীর সঞ্চয় কাজ ক্রমেই বাড়তে থাকে। নদী বাহিত নুড়ি, কাদা, পলি প্রভৃতি জমে নদীগর্ভ ভরাট ও অগভীর হয়ে যায়।
- বর্ষাকালে নদীর প্রবাহপথের এই অংশে নদীর জল হঠাৎ বেড়ে গেলে নদী উপত্যকায় প্লাবন বা বন্যা হয় ।
- প্লাবনের পর নদীর জল নেমে গেলেও নদীর উঁচু পাড় স্বাভাভিক বাঁধের মতো অবস্থান করায় নীচু সমতলভূমির জল বেরোতে পারে না, ফলে তারা প্লাবিত হয়েই থাকে।
- নদীর প্লাবনের জলে থাকা পলি নদী উপত্যকার নিম্ন অংশে থিতিয়ে পড়ে ও সঞ্চিত হয়। প্রায় প্রতি বছর এই অঞ্চলে নতুন পলি সঞ্চয় ঘটে।
- এইভাবে নদী উপত্যকার নিম্ন অংশে পলি সঞ্চয়ের ফলে যে ভুমিরুপের সৃষ্টি হয় তাকে প্লাবনভূমি বলে।
- নদীবাহিত পলি অনেকদিন ধরে নদীর দু’পাশে সঞ্চিত হলে পলিগঠিত যে সমতল ভূ-ভাগের সৃষ্টি হয় তাকে পলি সমভূমি বলে।
উদাহরণ: উত্তর প্রদেশের হরিদ্বার থেকে বিহারের রাজমহল পর্যন্ত নানান স্থানে গঙ্গার গতিপথের দু’পাশে প্লাবনভূমি ও স্বাবাভিক বাঁধ দেখা যায়। মিশরের নীল নদের গতিপথে প্রথমে প্রথমে স্বাভাবিক বাঁধ এবং পরে বিস্তৃত প্লাবনভূমি দেখা যায়।
ব-দ্বীপ:
নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত রকম ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ব-দ্বীপ হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ। নদী যেখানে সমুদ্রে এসে পড়ে তাকে নদীর মোহনা বলে। ব-দ্বীপ হল নদীর মোহনায় মাত্রাহীন বাংলা ব -অক্ষরের এর মত ত্রিকোণাকার এক রকম দ্বীপ [∆]। মোহনার কাছে নিম্ন গতিতে নদীর গতিপথের ঢাল একেবারে কমে যাওয়ায় নদীতে জলপ্রবাহের গতিবেগ খুব একটা থাকে না। মোহনার কাছে সাগরের জলে স্রোত কম থাকলে নদীগর্ভ, হ্রদ বা সাগরসঙ্গম নদীবাহিত পলি ( নুড়ি, কাঁকর, কাদা, বালি) জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় নতুন ত্রিকোণাকার ভূভাগ বা দ্বীপের সৃষ্টি হয়। দ্বীপের চারদিকে থাকে জল। নদী তখন সেই দ্বীপের দু-দিক দিয়ে বয়ে চলে। দ্বীপকে দেখতে গ্রিক অক্ষর ডেল্টা [∆] -এর মতো হলেও বাংলা অক্ষর মাত্রাহীন ব-এর সঙ্গে তার কিছুটা সাদৃশ্য থাকায় তাকে ব-দ্বীপবলা হয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ ব-দ্বীপই গ্রিক অক্ষর ডেল্টার মতো দেখতে হলেও, কোনো কনো ব-দ্বীপ বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে, যেমন, ভারতে কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী-মিসিসিপি নদীর বদ্বীপ অনেকটা পাখির পায়ার মতো দেখতে।
সাধারণত তিন ধরনের বদ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়, যেমন:-
- ত্রিকোণ আকৃতির ব-দ্বীপ(যেমন:-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, বদ্বীপ)।
- হ্রদ ব-দ্বীপ (হ্রদের ওপর গড়ে ওঠা বদ্বীপ:- কাস্পিয়ান সাগরে এই ধরনের বদ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়)।
- সমুদ্র ব-দ্বীপ (সমুদ্রের ওপর যে বদ্বীপ সৃষ্টি হয়, যেমন, সুন্দরবন বদ্বীপ)।
ব-দ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ:
নদীতে ব-দ্বীপ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশগুলি হল-
- মোহনার কাছে নদীর স্রোতের বেগ কম হওয়া দরকার।
- নদী তার মোহনার যে অংশে সাগর, উপসাগর, হ্রদে এসে মেশে সেখানকার গভীরতা হওয়া দরকার।
- নদীর জলে অবক্ষেপনযোগ্য বা সঞ্চয়যোগ্য পলির পরিমাণ বেশি হতে হবে।
- নদীবাহিত পলি দ্রুত অধঃক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য নদীর মোহনামুখে সমুদ্র জলের লবণত্ব বেশি হওয়ার প্রয়োজন।
- নদী মোহনায় সঞ্চয়ের হার সমুদ্রস্রোতের অপসারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ার জন্য নদীর মোহনামুখে জোয়ার-ভাটার আধিক্য কম হওয়া প্রয়োজন।
- নদী মোহনায় প্রচুর পলি সরবরাহের জন্য নদী অববাহিকার আয়তন বেশি হওয়া দরকার। এছাড়া উন্মুক্ত সমুদ্রের তুলনায় স্থলবেষ্টিত সমুদ্রে নদী পতিত হলে ব-দ্বীপ গঠনের পক্ষে সহায়ক হয়।
Post Comment