INFO Breaking
Live
wb_sunny

Breaking News

ফরাসি সংবিধান সভায় ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা:

ফরাসি সংবিধান সভায় ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা:


ফরাসি সংবিধান সভা মূল সংবিধান রচনার আগে ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা’ ('Declaration of Rights of Man and Citizen') নামে একটি দলিল প্রকাশ (২৬ আগস্ট, ১৭৮৯ খ্রিঃ) করে।

ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের ভিত্তি:
ফরাসি সংবিধান সভা কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্র’ রচনার ক্ষেত্রে ‘আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং ইংল্যান্ডের ‘ম্যাগনা কার্টা’ ও ‘বিল অব রাইট্স’, লক, রুশো, মন্তেস্কু প্রমুখ দার্শনিকের মতাদর্শ প্রভৃতির বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়।


ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ঘোষণার প্রকৃতি:
ব্যক্তি ও নাগরিকের ঘোষণাপত্রটি মূলত এক ইস্তাহার এবং এটি ফ্রান্সের প্রশাসনিক সংস্কার প্রকল্প নীতির বিবরণ। এই বিবরণে রয়েছে শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার প্রাপ্তির দাবি। এটি আসলে মানবাধিকার তথা নাগরিক অধিকারের ঘোষণাপত্র। ঐতিহাসিক লেফেভরের মতে – ঘোষণাপত্রটি ফরাসি বিপ্লবের চরিত্রের সনাতন দিকটি উদ্ঘাটিত করে।


ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারপত্র ঘোষণার গুরুত্ব:
ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রটি এক উচ্চ আদর্শের দলিলরূপে ফ্রান্স তথা বিশ্বের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই ঘোষণাপত্রের আদর্শগুলি শুধুমাত্র ফরাসি জাতিকেই অনুপ্রেরণা জোগায়নি, নিপীড়িত বিশ্ববাসীকেও অধিকার অর্জনের জন্য মনোবল জুগিয়েছিল। এই ঘোষণাপত্রটি পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু ঘটিয়ে নবযুগের সংকেত দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ওলার (Aulard) বলেছেন – এই ঘোষণাপত্র ছিল ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যুর পরোয়ানা' ('The Declaration was a death certificate of the Old Regime')। ঐতিহাসিক কোব্যান একে তাই 'নবযুগের বার্তা' বলে স্বাগত জানিয়েছেন।

এখানে বলা হয়েছে যে—
  •  স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
  •  আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।
  •  বাক্‌স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সম্পত্তি ক্রয় - বিক্রয়ের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
  •  সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনই আইনের উৎস।
  •  জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার স্বাধীনতা।
  •  ক্ষতিপূরণ ছাড়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না ইত্যাদি। ফ্রান্সের নতুন সংবিধান কার্যকরী হয় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে।


১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণাপত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়:

  •  সব মানুষই জন্মাবধি ও সারাজীবন স্বাধীন এবং তার অধিকার সার্বজনীন ও সকলের কাছে সমান।
  •  সব রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্দেশ্য হল, মানুষের স্বাভাবিক অধিকার, স্বাধীনতা, সম্পত্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার অধিকার।
  •  সব সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রধানত জাতির মধ্যেই বিদ্যমান। তাই কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় এখানে প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারে না।
  •  স্বাধীনতার স্বরূপ হচ্ছে অন্যের অনিষ্ট বা ক্ষতি না করে সবকিছুই সম্পন্ন করা। আইনের দ্বারা প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার তাই সীমিত থাকে।
  •  আইনের কাজ হল সমাজে অনিষ্টকর, আইনবিরুদ্ধ বা আইন - বহির্ভূত সব কাজকর্মকে প্রতিরোধ করা।
  •  যেহেতু আইন সার্বজনীন ইচ্ছার অভিব্যক্তি, তাই সব নাগরিক ব্যক্তিগতভাবে বা নিজ প্রতিনিধির মাধ্যমে আইন প্রণয়নের অধিকারী। প্রত্যেকেই আইনের চোখে সমান নিজ গুণ ও যোগ্যতা অনুসারে — কী পদে, কী চাকরিতে, কী রক্ষক, কী দণ্ডদাতা হিসাবে।
  •  আইনগত কারণ ছাড়া কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার, বন্দি বা অভিযুক্ত করা, স্বেচ্ছাচারী আদেশ প্রার্থনা বা পালন করা অসংগত ও অন্যায়। তবে আইনি সব পদক্ষেপ বা কোনো নাগরিককে সমন দিলে তা দ্রুত শিরোধার্য করা।
  •  আইনে নিশ্চিত ও অপরিহার্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। বিধিবদ্ধ আইন ছাড়া অপরাধের পূর্ব নজির যাচাই না করে কোনো নাগরিককে শাস্তি না দেওয়া।
  •  সব মানুষই দোষী প্রমাণ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে। কাউকে গ্রেপ্তারের দরকার হলে বন্দিকালীন অবস্থায় কঠোরতা আইন বরদাস্ত করবে না।
  •  কোনো নাগরিকের মতামত বা ধর্ম সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না । মোট কথা সমষ্টির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না করলে কাউকে চাপ সৃষ্টি করা অন্যায়।
  •  সব মানুষের সমান অধিকার হল তার চিন্তা ও মতামতে লেনদেন করা। স্বাধীনতার অপব্যবহার ছাড়া সব নাগরিকই কোনোকিছু বলতে, লিখতে বা ছাপাতে অবশ্যই পারবে।
  •  স্বার্থশূন্য হয়ে সবার সুবিধার্থে একটি শান্তিস্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানের দরকার, যা মানুষ ও নাগরিকের অধিকারগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে।
  •  নাগরিকদের গুণ অনুযায়ী যে কর (tax) দেবে তা দিয়ে নাগরিকের শান্তিরক্ষক প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ।
  •  নাগরিকের অধিকার থাকবে কর নির্ধারণের, অনুমোদনের, সদ্ব্যবহারের এবং কর আদায়ের পদ্ধতি ও সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
  •  সমাজের সকলের অধিকার থাকবে শাসনদপ্তরের সব কর্মচারীর কাছে জমা - খরচের হিসাব চাওয়া।
  •  যে সমাজে নিয়ম ব্যবস্থায় নিরাপত্তা নেই, বিভিন্ন শাসন বিভাগে স্বাতন্ত্র্য নেই, সেখানে সংবিধান মূল্যহীন।
  •  একমাত্র আইনসিদ্ধভাবে গণস্বার্থে, ন্যায্য ও অগ্রিম খেসারতের বিনিময় ছাড়া কোনো নাগরিককে সম্পত্তির মতো অলঙ্ঘনীয় ও পবিত্র অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। ঐতিহাসিক লেফেভরের মতে, 'এই ঘোষণাপত্রটি ফরাসি বিপ্লবের সনাতন চরিত্রটি ব্যক্ত করেছিল।'

0 Comments: